রবিবার, ৩ আগস্ট ২০২৫, সকাল ৯:৪২ সময়
হবিগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৫, ৩:৪৪ দুপুর
‘আমাদের দেখাইয়া অনেকে অনেক কিছু পাইছে, আর আমার বাচ্চারা হারাইছে বাপডাক। আমি হইছি স্বামীহারা। আমার বাচ্চাকাচ্চার ভবিষ্যৎ সবই রইয়া গেছে।’ চোখের কোণে জল নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন হবিগঞ্জে নিহত মোজাক্কির মিয়ার স্ত্রী সুজিনা আক্তার। গত বছর ৫ আগস্ট বানিয়াচংয়ে ছাত্রজনতার মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মোজাক্কির। এরপর থেকে তার স্ত্রী, দুই ছেলে ও বৃদ্ধা মায়ের জীবন থমকে গেছে। সুজিনা বলেন, ‘সেদিন মোজাক্কিরের হাতে ফোঁড়া ছিল, চিকিৎসা করাইছি। তবুও সে মিছিলে যাইতে চাইল। আমি অনেক বুঝাইছি, তবু শুনল না। যাওয়ার সময় বলল— “ভাত রাইখো, আইয়া খামু।” তারপর সে আর ফিরল না। হঠাৎ ফোনে জানলাম, হাসপাতালে নিতে হইছে। গিয়ে দেখি, লাশ হয়ে শুইয়া আছে।’ ভাঙারি ব্যবসায়ী মোজাক্কির ছিলেন পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। স্ত্রী, দুই সন্তান ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে চলে সংসার। ২০১৮ সালে বিয়ে, এরপর সাত বছরের দাম্পত্যজীবনে সঞ্চিত সব স্বপ্ন যেন মুহূর্তেই ভেঙে চুরমার। জুলাই আন্দোলনের পক্ষ থেকে সুজিনার হাতে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র তুলে দেওয়া হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত ও সরকারের পক্ষ থেকেও এসেছে প্রায় ৮ লাখ টাকার সহায়তা। কিন্তু তা দিয়ে সংসার টিকিয়ে রাখা কঠিন। ‘সঞ্চয়পত্রের মুনাফায় ছেলে দুটো স্কুলে যায়। ৮ লাখের মধ্যে শাশুড়ি ১ লাখ নিছে, বাকিটাও প্রায় ফুরাইছে। নতুন কইরা আয় করার কেউ নাই,’ — বলেন সুজিনা। মোজাক্কিরের বড় ছেলে মোশাহিদ (৭) মাদরাসায় প্রথম শ্রেণিতে পড়ে, ছোট ছেলে মোশারফ (৫) শিশু শ্রেণির শিক্ষার্থী। সুজিনার আকুতি, ‘আমি কোনো চাকরি চাই না, শুধু চাই আমার ছেলেদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিক সরকার। যেন ওরা মানুষ হইতে পারে।’ গ্রাম্য পরিবেশে স্বামীহীন জীবন, ছোট দুটি সন্তান আর বৃদ্ধা শাশুড়িকে নিয়ে প্রতিদিন যেন যুদ্ধ করছেন তিনি। মোজাক্কিরের চাচি পারুল বিবি বলেন, ‘ভালো পোলা আছিল। বলছিল— “শহীদ হইলে গর্বের ব্যাপার।” হইছে তো, কিন্তু বউমা আর নাতিপুতিরে ছাইড়া চলে গেল। জীবনে নামছে ঘোর অন্ধকার।’ মা খোশবানু বললেন, ‘পুতলা ঘরে আইয়া “মা মা” কইত, মনটা জুড়াইত। গেছিল, আর আইল না। আর কিছু কইবার নাই।’ মোজাক্কিরের মৃত্যুর পর তার বোন হাফিজা বেগম একটি পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়ে বৃদ্ধা মায়ের দেখভাল করছেন। ৫ আগস্টের ঘটনা ওইদিন সাগরদিঘীর পশ্চিমপাড় ঈদগাহ মাঠ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি মিছিল বের হয়। প্রায় ১০ হাজারের বেশি লোক গ্যানিংগঞ্জ হয়ে শহীদ মিনারে জড়ো হয়। পরে থানা মোড়ে পুলিশের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে বিক্ষোভকারীরা ইটপাটকেল ছোড়ে। পুলিশ পাল্টা গুলি, রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, সেদিন ঘটনাস্থল ও হাসপাতালে মারা যান অন্তত আটজন। আন্দোলনকারীরা পিটিয়ে হত্যা করে এক সাংবাদিককে। পরে থানার সামনে এক এসআইকেও পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এসআই সন্তোষ হত্যাকাণ্ডে পুলিশের পক্ষ থেকে, আহত ছাত্রের বাবার পক্ষ থেকে ও নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে মোট তিনটি মামলা হয়। অভিযুক্তের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। নিহতরা হলেন— হোসাইন মিয়া, আশরাফুল ইসলাম, তোফাজ্জল হোসেন, মোজাক্কির মিয়া, সাদিকুর রহমান, শেখ নয়ন হোসেন, সোহেল আখঞ্জী, আকিনুর রহমান ও আনাস মিয়া।